• এসএ গেমস
  • " />

     

    ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি-৩ঃ রেজিস্তাদের রাজত্বে

    ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি-৩ঃ রেজিস্তাদের রাজত্বে    

     

    ২০০১ সালে ৩০ বছর বয়সে পেপ গার্ডিওলা যখন বার্সেলোনা থেকে ট্রান্সফার হয়ে সিরি আ-র ক্লাব ব্রেসিয়াতে যোগ দেন, তখন সবাই একটু বিস্মিতই হয়েছিল। কারণ গার্ডিওলা ছিলেন বার্সেলোনার অধিনায়ক, ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে ১৭টি ট্রফি ঘরে তুলেছেন ক্যাটালান ক্লাবটিতে থেকে। এরকম শিরোপাময় উজ্জ্বল বায়োডাটা যার হাতে আছে তিনি কি আরো বড় ক্লাবে যেতে পারতেন না?

     

    এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কিঞ্চিৎ হতাশ হয়েই জবাব দিয়েছিলেন, "এখনকার খেলায় রেজিস্তাদের কোন জায়গা নেই, সবাই মাঝমাঠে চায় মারকুটে খেলোয়াড়। রেজিস্তাদের রেজিস্তা পিরলোকেও যখন বড় ক্লাবরা জায়গা করে দিতে পারে না, তখন ধরে নেওয়া যায় যে রেজিস্তাদের রাজত্ব এখানেই শেষ। ” ব্যাপারটা একেবারে অতিরঞ্জিত ছিল না অবশ্য। ব্রেসিয়াতে গার্ডিওলা যোগ দিয়েছিলেন পিরলোর বদলি হিসেবে, কারণ পিরলোকে এর দুই মৌসুম আগে ইন্টার মিলান কিনে নিয়েছে, এবং এর পর থেকে ব্রেসিয়া পয়েন্ট টেবিলের শেষে রেলিগেশন এড়ানোর লড়াই লড়ে যাচ্ছিলো।

     

    একজন রেজিস্তাকে তাদের রণকৌশলে জায়গা করে দেবে, এরকম ক্লাব তখন ইউরোপে ছিল হাতে গোণার মত। পিরলোও শেষ পর্যন্ত ইন্টারে জায়গা করে নিতে পারেন নি, ২০০০-২০০১ মৌসুমে ইন্টার থেকে তিনি আবার ধারে ফেরত আসেন তাঁর পুরনো ক্লাব ব্রেসিয়াতে। গার্ডিওলা-পিরলো-ব্যাজ্জিও জাদুতে ব্যাকবেঞ্চের ব্রেসিয়া উঠে আসে কোপা ইতালিয়ার কোয়ার্টার ফাইনালে এবং বছর শেষ করে ৭ম হয়ে। ব্রেসিয়ার ম্যানেজার কার্লো মাজ্জোনিই প্রথমবারের মতো পিরলোকে রেজিস্তা হিসেবে ব্যবহার করেন এবং … বাকিটা? বাকিটা কেবলই ইতিহাস, বা বর্তমান!!

     


    আরো পড়ুনঃ

    ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি-১ঃকাতেনাচ্চিওর 'কূটকৌশল'


     

    রেজিস্তা কি, রেজিস্তা কারা?

     

    বর্তমান সময়ে রেজিস্তা এবং ডিপ লাইং প্লেমেকার সমার্থক শব্দ। তবে তখনকার রেজিস্তাদের ভূমিকা আর বর্তমান ডিপ লাইং প্লেমেকারদের খেলার ধরণে কিছুটা পার্থক্য আছে। ইতালিয়ান ‘রেজিস্তা’ শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক শব্দ – এর অর্থ পরিচালক (ডিরেক্টর) এবং যোগানদাতা (প্রডিউসার) দুটোই হতে পারে। তবে ফুটবলে রেজিস্তাদের এই দুটো দায়িত্বই সমানভাবে পালন করতে হয়।

     

    একজন রেজিস্তার কাজ হল মাঝমাঠের পেছনে বসে থেকে খেলার গতি ও প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের বলের যোগান দেওয়া। সাধারণত একজন রেজিস্তা দলের রক্ষণ এবং আক্রমণভাগের মাঝে একমাত্র যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। কোনো দলে রেজিস্তা থাকলে রক্ষণে কেউ যদি বল জিতে নেয় তবে তাঁর কাজ হবে আগে রেজিস্তার কাছে বলটি পৌঁছানো। এরপর বল কার কাছে যাবে - থ্রু হবে না লম্বা ডায়াগনাল হবে বা উইং সুইচ হবে সবই নির্ধারণ করবার দায়িত্ব রেজিস্তার। বিপক্ষ দল যদি অতিমাত্রায় প্রেসিং করে খেলে, তবে বলের দখল নিয়ে খেলার গতি কমানোর দায়িত্বও রেজিস্তার। আবার নিজের দল যদি দ্রুত কাউন্টারে যেতে চায়, তবে সেক্ষেত্রে খেলার গতি বাড়ানোটাও রেজিস্তারই কাজ। মোদ্দা কথা, একজন অর্কেস্ট্রার কন্ডাকটরের মতো রেজিস্তা তাঁর বাজনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করবেন।

     

    পেপ গার্ডিওলাকে রেজিস্তাদের পথিকৃৎ ধরা হয়, এবং আন্দ্রেয়া পিরলোকে আদর্শ। গার্ডিওলা যদিও ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন যে রেজিস্তাদের রাজত্ব শেষ, কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। জাভি, স্কোলস, ক্যারিক, আলোনসো থেকে শুরু করে হালের ভেরাত্তি, মদ্রিচ, গুন্ডোগান, রাকিটিচ, থিয়াগো আলকান্ত্রা - এ যুগের সব চ্যাম্পিয়ন দলেরই একজন করে সর্বোচ্চ শ্রেণীর রেজিস্তা ছিল এবং আছে।

     

    ব্যাপারটা এভাবেও বলা যায় যে, আপনার দলটি কতো ভাল তা এখন নির্ভর করে আপনার দলের রেজিস্তার কোয়ালিটি এবং পারফরম্যান্সের ওপর। এই যুগের প্রায় সকল বিশ্বকাপ-ইউরো-চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী দলেরই একজন করে প্রথম শ্রেণীর রেজিস্তা ছিল। একমাত্র হয়তো মরিনহোর ইন্টার মিলানই এর ব্যতিক্রম; সেখানে রেজিস্তা নিয়োগ না করে রক্ষণে শক্তি বাড়িয়েছেন ‘স্পেশাল ওয়ান’ এবং আক্রমণভাগের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দায়িত্ব ছিল ট্রাডিশনাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ওয়েসলি স্নাইডারের ওপর।

     

    রেজিস্তার জন্ম

     

    রেজিস্তার ধারণাটা কিন্তু ফুটবলের ইতিহাসে বেশ প্রাচীন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইতালির কিংবদন্তী ম্যানেজার ভিত্তরিও পোজ্জো সর্বপ্রথম ফুটবল মাঠে 'রেজিস্তা' ধরনের একটা চরিত্র সৃষ্টি করেন। সেই সাথে তিনি তাঁর ‘মেতোডো’ ফর্মেশনের সাথেও বিশ্ববাসীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ফুটবলের রণকৌশলে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন, তবে সেই গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।

     

    ইংল্যান্ডে বেশ কিছু সময় কাটাবার কারণে খুব কাছ থেকে ইংলিশ খেলোয়াড় এবং ইংলিশ খেলার স্টাইলের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল পোজ্জোর। সেখানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সেন্টার হাফ চার্লি রবার্টসের খেলা তাকে বেশ আকর্ষণ করে। এখানে বলে রাখা ভাল, ঐ আমলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফর্মেশনগুলোর একটি ছিল ‘পিরামিড’ বা ২-৩-৫ ফর্মেশন। চার্লি রবার্টস ছিলেন সেন্টার হাফ, অর্থাৎ মাঝমাঠের মাঝে। সেন্টার হাফ হিসেবেও তাঁর পাসিং দক্ষতা এবং কোনো আক্রমণের সূচনা করার আগ্রহের ব্যাপারটা চোখে লেগে যায় পোজ্জোর।

     

    সে যুগে মাঝমাঠের লেফট, রাইট এবং সেন্টার হাফদের দায়িত্ব ছিল প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডদের মার্ক করা এবং রক্ষণ থেকে আক্রমণে বল চালান করা, অর্থাৎ রক্ষণ ছাড়া খুব একটা দায়িত্ব পালন করতে হতো না তাদের। চার্লি রবার্টসকে দেখে পোজ্জোর মাথায় এলো যে, ৫ জনকে রক্ষণের দায়িত্বে না রেখে যদি ৪ জন ঘর সামলায় এবং একজন সেন্টার হাফ বল বিতরণের দায়িত্ব নিয়ে খেলাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তবে কেমন হয়? ইতালিতে ফিল্ম ডিরেক্টরদেরকে রেজিস্তা বলা হয়; পোজ্জো এখানে খেলার পরিচালকের এই দায়িত্ব দিলেন সেন্টার হাফকে, তার নামও হলো রেজিস্তা। পুরনো ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে পোজ্জো তৈরী করলেন তাঁর বিখ্যাত ‘মেতোদো’ বা ২-৩-২-৩ ফর্মেশন।

     

    ২-৩-৫ ফর্মেশন (পিরামিড)

     

    আর্জেন্টাইন সেন্টার হাফ লুইস মন্টি যখন ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে খেলেন, তখন তাঁর বয়স ২৯। বিশ্বকাপের পর মন্টি তাঁর নানাবাড়ি ইতালিতে ফিরে আসেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছে, ওজন বেড়েছে এবং কমেছে গতি - সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার সুযোগ তখন সময়ের সাথে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে দিনকে দিন।

     

    কিন্তু পোজ্জোর এরকমই একজনকে দরকার ছিল। তাঁর মাথায় রেজিস্তার যে ধারণা ছিল, সেটার জন্য গতিহীনতা বা বয়স কোন ব্যাপার না। বিশ্বকাপের খেলা দেখেই পোজ্জো মন্টিকে মনে মনে তাঁর রেজিস্তা হিসেবে ঠিক করে নিয়েছিলেন। মন্টিকে ইতালির নাগরিকত্ব দেওয়া হল, সেই সাথে দেওয়া হলো ইতালির জাতীয় দলে রেজিস্তার দায়িত্ব। রেজিস্তার চাকরির বিবরণ খুবই সোজাসাপ্টা, বল হারালে রেজিস্তা নিচে নেমে সেন্টার ব্যাক হয়ে যাবে এবং বল পায়ে এলে রেজিস্তা সামনে বাড়িয়ে আক্রমণের সূচনা করবে। ৩৩ বছর বয়সী লুইস মন্টিকে মধ্যমণি করে ভিত্তরিও পোজ্জো সাজালেন তাঁর মেতোদো ফর্মেশন; এবং ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপ জিতে ঘরে ফিরলেন।   

     

    ভিত্তরিও পোজ্জোর 'মেতোদো' ফর্মেশন

     

    রেজিস্তার পুনর্জন্ম

     

    সত্তর-আশির দশকের দিকে ইতালিয়ান ফুটবল এবং পরে গোটা বিশ্বে রেজিস্তার ধারণাটা জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে। এর আগের যুগে প্লেমেকার বা ফ্যান্তাসিস্তাদের প্রতিপত্তি ভয়ানক বেড়ে গিয়েছিল। দলে জিকো, সক্রেটিস, রিভেলিনো, শিয়াফিনো, সুয়ারেজ, প্লাতিনিদের মতো প্লেমেকাররা থাকলে তাঁরা তাঁদের একক নৈপুণ্যেই অনেক খেলা বের করে আনতে পারতেন। এই প্লেমেকারদের দাপট ঠেকাবার জন্য ম্যানেজাররা ফরোয়ার্ডদের বদলে প্লেমেকারদের মার্কিং করার জন্য এক দুইজন ডিফেন্ডার ঝুলিয়ে দিতে থাকলেন। এই সিদ্ধান্তই ইতিহাসের প্রথম রেজিস্তাদের লাইমলাইটে আগমনের সুযোগ করে দেয়।

     

    জারসন, নেটজার, ফ্যালকাও, ওবলাক, টরিনহোরা প্লেমেকার ছিলেন, কিন্তু তাদের আবাসস্থল ছিল মাঝমাঠের পেছনে। নিজের অবস্থান ছেড়ে এতো দূর এসে প্রতিপক্ষের কোন ডিফেন্ডার এই প্লেমেকারদের মার্কিং করার সাহস করবে না এটা নিশ্চিত, আবার লম্বা পাস, ডিফেন্স চেরা থ্রু বা উইং পরিবর্তন করার মাধ্যমে এরা পেছন থেকেই তাঁদের অর্কেস্ট্রার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এভাবেই ব্যাপ্তি পেলো ফুটবলের রঙ্গমঞ্চের রেজিস্তা চরিত্রটি। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দুজন রেজিস্তাকে মাঠে নামিয়েছিল, ফ্যালকাও এবং টরিনহো। পরবর্তীতে তাঁরা সিরি আ-তে যথাক্রমে রোমা এবং সাম্পাদোরিয়ার হয়েও একই দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন।

     

    '৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ফর্মেশন

     


    আরো পড়ুনঃ

    ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি-২ঃ গেগেনপ্রেসিং


     

    সিঙ্গেল নাকি ডাবল পিভট?

     

    এখানে মনে রাখা উচিত যে রেজিস্তা ব্যাপারটা মিডফিল্ডার, ডিফেন্ডার, অ্যাটাকারের মতো কোন ফুটবলিং পজিশন নয়, এটি একটি দায়িত্ব, অনেকটা দলের অধিনায়কের মতনই। প্রতি ম্যাচেরই একটা গেমপ্ল্যান থাকে এবং সেটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব থাকে দলের রেজিস্তার ওপর। একটি দল একজন রেজিস্তাকে সফলভাবে তখনই ব্যবহার করতে পারবে, যদি তারা ঐ রেজিস্তাকে কেন্দ্র করে তাদের দল এবং খেলার রণকৌশল নির্ধারণ করে।  

     

    রেজিস্তা এবং ডিপ লাইং মিডফিল্ডারদের পার্থক্যটা হল রক্ষণের দায়িত্ব এবং দক্ষতায়। একজন রেজিস্তাদের রক্ষণের দায়িত্ব খুব একটা পালন করতে হয় না, এ কারণে একজন প্রথম শ্রেণীর রেজিস্তাকে দক্ষ ট্যাকলার বা লম্বা-চওড়া ক্ষমতাবান বা খুব ক্ষীপ্র হতে হবে এমন কথা নেই। এক্ষেত্রে ম্যানেজারদের একটু ঝামেলা পোহাতে হয়। কারণ কোন ম্যানেজার যদি একটু বেশি সতর্ক বা রক্ষণাত্মক হন তবে মাঝমাঠের পিছনে শুধু একজন রেজিস্তাকে রাখা একটু বিপজ্জনকই বটে।

     

    এক্ষেত্রে যেটা করা হয়, রেজিস্তার সাথে জুটি বেঁধে দেওয়া হয় রক্ষণশিল্পে দক্ষ বা ক্ষেত্রবিশেষে মারকুটে ধরনের প্লেয়ার – ফুটবলের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ডেস্ট্রয়ার’। যেমন, ইতালি বা মিলানে পিরলোর জুটি হিসেবে ছিলেন জেনারো গাত্তুসো এবং সম্প্রতি এই দায়িত্ব পালন করছেন ডি রসি। বার্সায় জাভির রক্ষাকবচ ছিলেন সার্জিও বুস্কেটস। আর্সেনালে ককেলানের দায়িত্ব সান্তি কাজরোলাকে দেখেশুনে রাখার। এই ধরণের রণকৌশলকেই আমরা ‘ডাবল পিভট’ হিসেবে জানি। তবে জুভেন্টাসে পিরলো ‘সিঙ্গেল পিভট’ সিস্টেমেও খেলেছেন এবং সেক্ষেত্রেও তিনি সফল।  ডাবল পিভটে খেললে ৪-২-৩-১  এই সবচেয়ে জনপ্রিয় ফর্মেশন। আর সিঙ্গেল পিভট নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ আছে, এক্ষেত্রে ৪-১-৩-২ বা ৫-১-২-৩ বা ৫-১-৩-১ যেকোন ধরনের ফর্মেশনই ম্যানেজার পছন্দ করতে পারেন তাঁর দলের সামর্থ্য এবং দর্শন অনুযায়ী।

     

    রেজিস্তা-ডেস্ট্রয়ার জুটির কার্যকারিতা

     

    জুভেন্টাসের সিংগল পিভট সিস্টেমে সাফল্য আসার কারণ ছিল তুরিনের ক্লাবটির রক্ষণকৌশল। রক্ষণাত্মক খেলার প্রয়োজন হলে পিরলো আরো নিচে নেমে বনুচ্চির প্রায় সমান্তরালে দাঁড়িয়ে যেতেন, সেক্ষেত্রে কিয়েলিনি এবং বারজাগলি উইংয়ের দিকে সরে গেলেই রক্ষণে চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে যেত। আবার মাঝমাঠে যদি রক্ষণাত্মক সাপোর্টের প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে বনুচ্চি কিছুটা ওপরে উঠে পিরলোর ‘ডেস্ট্রয়ার’ জুটি হয়ে যেতেন। ঐ সময়ে কিয়েলিনি এবং বারজাগলি চেপে এসে সেন্টার ব্যাকের কাভার দিতেন এবং এভরা বা লিখস্টাইনারদের মাঝে যেকোন একজন উইং ব্যাক নিচে নেমে রক্ষণের বাড়তি সাপোর্ট হিসেবে প্রস্তুত থাকতেন। ওদিকে মাঝমাঠে ভিদাল, পগবা এবং মার্কিসিও - তিনজনেরই আছে সেই বাড়তি গতি এবং শক্তি যা পিরলোর দুর্বলতাগুলোকে সুন্দরভাবে ঢেকে দেওয়ার জন্য একেবারে পারফেক্ট! 

     

    জুভেণ্টাসের রেজিস্তা কেন্দ্রিক ফর্মেশন

     

    রেজিস্তাদের রাজা এবং তাঁদের রাজত্ব

     

    রেজিস্তা হিসেবে পিরলোকে সম্ভবত সবচেয়ে ভালভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন কার্লো অ্যানচেলত্তি তাঁর মিলানের স্বর্ণযুগে। পিরলোকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য মিলানে ছিলেন গাত্তুসো এবং অ্যামব্রোসিনি। কিন্তু ২০০৯ সালে অ্যানচেলত্তির বিদায়ের পর পিরলোরও মিলান থেকে বিদায়ের ঘন্টা বেজে যায়। কারণ অনেক ম্যানেজারের মতোই মিলানের পরবর্তী অভিভাবক অ্যালেগ্রি রক্ষণভাগের দৃঢ়তায় বিশ্বাসী ছিলেন। এ কারণে মাঝমাঠে অ্যামব্রোসিনির সঙ্গী হিসেবে মিলানে জুটলেন ডেস্ট্রয়ার হিসেবে নাম (বা বদনাম) করা মার্ক ভ্যান বোমেল।

     

    পিরলোর নতুন ঠাঁই হল তুরিনের বুড়ি জুভেন্টাসে। পিরলোর জন্য কত খরচ হয়েছিল জুভেন্টাসের? একটা ফুটো ইউরোও নয়! কারণ ৩২ বছর বয়সে যখন পিরলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন মিলানের হর্তাকর্তারা ধরেই নিয়েছিলেন পিরলোর খেলোয়াড়ি জীবনের সূর্য ডুবে গেছে। কিন্তু সবাইকে রেজিস্তাদের মাহাত্ম্য বুঝিয়ে দিতে পিরলো পরবর্তী চার মৌসুমের প্রতিটিতেই স্কুডেট্টো জুভেন্টাসের ঘরে তুললেন। জুভেন্টাসে তাঁর শেষ মৌসুমে ম্যানেজার হয়ে এলেন তাঁকে মিলান থেকে অনেকটা তাড়িয়ে দেয়া ম্যাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি। কিন্তু এবার আর অ্যালেগ্রি ভুল করলেন না। জুভেন্টাসকে ৪-১-৩-২ ফর্মেশনে খেলিয়ে পিরলোকে দিলেন তাঁর প্রাপ্য জায়গা এবং সম্মান।

     

    পিরলো মিলানের হয়ে দুইটি চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা ঘরে তুলেছেন। কিন্তু সংখ্যাটা বাড়েনি এ যুগের আরেকজন রেজিস্তা জাবি আলোনসোর প্রভাবে। ইস্তাম্বুলের ঐ স্মরণীয় ফাইনালই বিশ্ববাসীকে ‘ডাবল পিভট’ সিস্টেমের উপযোগিতা এবং রেজিস্তাদের দুর্বল দিক চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। 

     

    খেলার প্রথমার্ধে লিভারপুলের ম্যানেজার রাফায়েল বেনিটেজ মাঝমাঠের পেছনে একা আলোনসোকে খেলালেন। ফলাফল? মিলান ৪৫ মিনিটের মাঝেই মোটামুটি ম্যাচ জেতা নিশ্চিত করে ফেলল। এরপর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আলোনসোর সাথে মাঝমাঠের পেছনে যুক্ত হলেন ডিটমার হামান, 'সেকেন্ড পিভট' হিসেবে। খেলার নকশা বদলে গেল। এখান থেকেই মূলত ম্যানেজাররা বুঝতে পারলেন যে বড় ম্যাচে যদি রক্ষণাত্মক খেলার দরকার পরে তাহলে সরাসরি চিরাচরিত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার না খেলিয়ে ডাবল পিভটে একজন রেজিস্তাকে জায়গা করে দেওয়াটা বরঞ্চ বেশি ফলপ্রসু।  
     

    রেজিস্তাদের আরেকটা অভাবনীয় বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্যান্য ফুটবলারদের থেকে তাদের আলাদা করে রাখে। যেখানে একজন সাধারণ প্লেমেকার ৩০ বছর বয়সী হলে ধরা হয় সে তার ফর্মের শীর্ষে আছে, সেখানে একজন রেজিস্তা শীর্ষে আরোহণ শুরুই করে ৩০ বছর বয়সের আশেপাশে। একজন রেজিস্তা হওয়ার প্রধান শর্ত হল বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি এবং নির্ভুলভাবে বল এগিয়ে দিয়ে একটি আক্রমণের সূচনা করা। এসকল গুণই বয়সের সাথে সাথে আরো তীক্ষ্ণ হবে - এটাই স্বাভাবিক, এবং এই তত্ত্বের প্রমাণ চাইলে পিরলো, আলোনসো, জাভি, স্কোলসের ক্যারিয়ারের দিকে নজর বোলালেই হয়। বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখানোটাই যে রেজিস্তাদের বৈশিষ্ট্য!

     

    বর্তমান আমলে রেজিস্তাদের রাজত্বের আরেকটা কারণ হল, অফসাইডের এখনকার নতুন নিয়ম কানুন। গত দুই দশক ধরেই অফসাইডের আইন কানুন একটু একটু করে পরিবর্তন হয়েছে; বিশেষ করে ২০০৬ সালে অফসাইডের অ্যাকটিভ প্লেয়ার, ইন্টারফিয়ারেন্স ইত্যাদি নিয়ম যুক্ত হওয়ায় এখনকার দলগুলোর রক্ষণের লাইন সবসময়ই একটু আগে এগিয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষকে অফসাইডের ফাঁদে ফেলবার চেষ্টায় থাকে। এর কারণে এখন রেজিস্তাদের জন্য সামনে পাস বা থ্রু দেওয়ার খালি জায়গা অন্তত গড়ে বিশ-ত্রিশ গজ বেড়ে গিয়েছে। এই অফসাইড ট্র্যাপের পাল্টা সুযোগ নিয়েই বার্সেলোনায় জাভি হার্নান্দেজ লাইনের পেছন থেকে অসংখ্য চোখ কপালে তোলা থ্রু দিয়ে বার্সেলোনার বিজয়রথ হাঁকিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এতকাল।

     

    ডিফেন্সিভ লাইন, রেজিস্তাদের জন্য আরেকটি অস্ত্র হতে পারে

     

    রেজিস্তাদের বর্তমান সাফল্যের আরেকটি বড় কারণ, মাঝমাঠে দলগুলোর লাইন বজায় রাখা। অতীতে কেবল রক্ষণভাগের প্লেয়ারদের কড়াভাবে ডিফেন্সিভ লাইন বজায় রাখতে হতো, কিন্তু ডিয়েগো সিমিওনে তাঁর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে যদি মাঝমাঠেও লাইন মেইনটেইন করা যায়, তবে চার্জ করে বল জিতে নেওয়ার জন্য আপনার কোন ডেস্ট্রয়ারের প্রয়োজন পড়বে না। সেক্ষেত্রে ডাবল পিভটের বদলে কোকের মত একজন রেজিস্তাধর্মী খেলোয়াড়কে মাঠে রাখাটাই যথেষ্ট।

     

    সিমিওনের 'মিডফিল্ড লাইন'

     

    এখন অনেকেই ডাবল পিভটের পরিবর্তে সিঙ্গল পিভটে একজন ডিপ লাইং প্লেমেকার বা রেজিস্তা ব্যবহার করবার সৎসাহস দেখাচ্ছেন কারণ আজকালকার খেলাতে শারীরিক দক্ষতার থেকে কৌশলগত দক্ষতা এবং গতিকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে যদিও আলোনসো, পিরলোর মতো রেজিস্তারা - যাঁরা গতির দিক থেকে খানিকটা পিছিয়ে আছেন অন্যদের থেকে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং চকিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ব্যবহার করে এই ঘাটতিটা সহজেই পুষিয়ে নিতে পারেন। সবচেয়ে ভাল হয় যদি জুভেন্টাস বা বায়ার্নের মতো ব্যাক লাইনের ভাল সাপোর্ট থাকে। তাহলে দুশ্চিন্তার পারদ থাকবে আরো নিচে!

     

    বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ গতির অভাবকে পুষিয়ে দিতে পারে

     

    সময়ের সাথে সাথে রেজিস্তাদের খেলার ধরনও বদলেছে। পল স্কোলস, পিরলোর মতো ক্লাসিক রেজিস্তারা সাধারণত মাঝমাঠের পেছন থেকে লম্বা ডায়াগনাল বল খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু বার্সেলোনার টিকি-টাকা সিস্টেমে লম্বা বলের ফুরসত ছিল কম, এ জন্য জাভিকে স্বাভাবিক রেজিস্তা পজিশনের থেকে আরো একটু ওপরে এসে খেলতে হতো। আর এ কারণেই তাকে বাড়তি সাপোর্ট দেওয়ার জন্য সার্জিও বুস্কেটসকে বার্সা-বি থেকে ডেকে নিয়ে এলেন গার্ডিওলা।

     

    পেপ নিজেও যেহেতু একজন রেজিস্তা ছিলেন এবং খুব কাছ থেকে জাভি, পিরলোর মতো রেজিস্তাদের দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর, কাজেই বায়ার্নে তিনি এক ঝাঁক খেলোয়াড়কে এমনভাবে তৈরী করলেন যারা প্রয়োজনে রেজিস্তা হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারবে। শোয়াইনস্টাইগার, আলোনসো, মার্টিনেজ, আলাবা, লাম, আলকান্ত্রা এদের প্রত্যেকেরই বর্তমানে পেছন থেকে খেলা নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষমতা আছে। বর্তমানে পিএসজির মার্কো ভেরাত্তিকে অনেকে পিরলোর উত্তরসুরী করবার জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। পিরলো হতে না পারলেও ভেরাত্তি যে যোগ্য, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

     

    পিরলো এবং তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসুরী ভেরাত্তির তুলনা

     

    '৩০ এর দশকের লুইস মন্টি থেকে শুরু করে ফ্যালকাও, গার্ডিওলা, পিরলো, জাভি এমনকি হালের টনি ক্রুস, মার্কো ভেরাত্তি পর্যন্ত সবসময়ই রেজিস্তারা বড় বড় খেলার ভাগ্য নির্ধারণ করে গিয়েছেন। গার্ডিওলা ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন রেজিস্তাদের রাজত্ব শেষ, রেজিস্তাদের রাজা পিরলো তখন প্রমাণ করে দিয়েছেন তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ভুল। অ্যালেগ্রি ধারণা করেছিলেন পিরলোর আর দেওয়ার কিছু নেই, পরপর চারটি স্কুডেট্টো জিতিয়ে পিরলো সেই ধারণাও ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন।

     

    শেষ পর্যন্ত ৩৬ বছর বয়সে ইউরোপিয়ান খেলার পাট চুকিয়ে পিরলোকে অবশেষে ফুটবল তারকাদের 'রিটায়ারমেন্ট হোম'-এ পাড়ি জমাতে হয়েছে, কারণ তাঁর বয়স ৩৬ - যে বয়সে আসলে কোন ফুটবলারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার কোন কারণ নেই। তবে যারা এরকম মনে করে, তারা ভুলে যায় যে যুগে যুগে রেজিস্তারা প্রমাণ করে গিয়েছেন যে তাঁদের জন্য বয়স কোন ব্যাপার না। এবং রিটায়ারমেন্ট হোমে গিয়েও রেজিস্তাদের রাজা 'দা আর্কিটেক্ট' আন্দ্রেয়া পিরলো সেটা আবারো বিশ্ববাসীর চোখে আঙ্গুলে দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন... 

    এতে অবাক হওয়ার কি আছে?