• ফুটবল, অন্যান্য
  • " />

     

    ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি-৪ঃ একজন শূন্যসন্ধানী বা 'রমডয়টারের' গল্প

    ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি-৪ঃ  একজন শূন্যসন্ধানী বা 'রমডয়টারের' গল্প    

    সাংবাদিক: তাহলে আপনার খেলার স্টাইলকে আপনি কিভাবে বর্ণনা করবেন। কারণ সকলের মতে ( এবং আমারও ),আপনার মতো  খেলার ধরণ আগে কখনো দেখা যায় নি।

    মুলার: হতে পারে, হতে পারে। আমার মতো ড্রিবলার অবশ্য অনেকেই আছে বা আমার মতো ফিনিশারও আছে অনেক। কিন্তু আমি আসলে কী? আমি মেসি, নেইমার বা রোনালদোর মতো নই, এটা আমি জানি। আমার স্কিল সেট পুরোপুরি অন্যরকম।

    সাংবাদিক: হ্যাঁ মুলার, ওটাই আমার প্রশ্ন ছিল।

    মুলারঃ হুম… আমি কি? শূন্য সন্ধানী? হ্যাঁ, আমি নিজেকে শূন্য সন্ধানী বলতে পারি, এই লেখার শিরোনাম হিসেবেও মন্দ হবে না কি বলেন?
     

    সেরকমটাই হল, ঐ সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল “Ich bin ein reumdeuter” অর্থাৎ আমি একজন শূন্য সন্ধানী। এবং সৃষ্টি হল নতুন একটি ফুটবলীয় পরিভাষা -  রমডয়টার।

     

     

    জার্মান 'রমডয়টার'-র ইংরেজি মানে ''স্পেস ইনভেস্টিগেটর'' বা বাংলায় আমরা বলতে পারি 'শূন্য সন্ধানী' - থমাস মুলারের দেওয়া একটি নাম হলেও বর্তমানে ফুটবল ট্যাকটিশিয়ান  এবং বিশ্লেষকেরা এই নতুন পরিভাষাটিকে আপন করে নিয়েছেন। ফুটবলে শূন্য সন্ধানী আসলে কোন পজিশন নয় বরং একটি রোল যা অ্যাটাকিং থার্ডের যেকোন অ্যাটাকারকে দেওয়া যেতে পারে। রমডয়টার আসলে একটি ফ্রি রোমিং রোল, একজন রমডয়টারকে ফুটবল মাঠে ঘোরাফেরা, দৌড়াদৌড়ি এবং নিজের অবস্থান পরিবর্তন করার সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দেওয়া হবে এবং এর বিনিময়ে তাঁকে এনে দিতে হবে গোল!

    ফ্রি রোলের ধারণাটা ফুটবলে নতুন কিছু না, যুগে যুগে ফলস নাইন, ত্রেকার্তিস্তা(অ্যাডভান্সড প্লেমেকার), ইনসাইড ফরোয়ার্ড, ইনভার্টেড উইংগার ইত্যাদি পজিশনের বিবর্তন হয়েছে খেলোয়াড়দের ফ্রি রোলের ধারণার ওপর ভর করেই। তবে থমাস মুলার যেভাবে তাঁর ‘রমডয়টার’ ধারণাটা ফুটবলবিশ্বকে দেখিয়েছেন সেটা আসলেই অনন্য এবং অভূতপূর্ব। যেহেতু এ ধরনের রোল বা খেলোয়াড় আগে দেখা যায় নি কাজেই আমাদের এই রমডয়টার বিষয়ক আলোচনা মুলার-কেন্দ্রিকই থাকবে।

     


    আরও পড়ুন:

    ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি ৩ : রেজিস্তাদের রাজত্বে


     

    কেন রমডয়টার দরকার?

    ফুটবলের খুঁটিনাটি নিয়ে জানেন এমন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন একজন ইনসাইড ফরোয়ার্ড এবং একজন রমডয়টারের মাঝে আসলে পার্থক্যটা কোথায়? পার্থক্যটা আসলে কৌশল এবং খেলার ধরণে। একজন রমডয়টার আক্রমণের ক্ষেত্রে কতোটুকু স্বাধীনতা পান, তা আধুনিক অ্যাটাকিং রোলগুলোর একটা ছোট তুলনা থেকে আশা করি সহজে বুঝে ওঠা সম্ভব। 

     

     

    প্রতিপক্ষের
    বক্স 
    পর্যন্ত এগোনো

    পজিশন
    হোল্ড করা

    ওয়াইড পজিশনে
    থাকা

    ওয়াইড চ্যানেলে
    ওঠানামা করা

    ন্যারো চ্যানেলে
    অপেক্ষা করা

    চ্যানেল পরিবর্তন
    করা

    নিজের
    পজিশনের আশেপাশে
    ঘোরাঘুরি করা

    ড্রিবল করা

    উইঙ্গার

    না

    ক্ষেত্র বিশেষে

    হ্যাঁ

    হ্যাঁ

    না

    না

    ক্ষেত্র বিশেষে

    ক্ষেত্র বিশেষে

    ইনসাইড ফরোয়ার্ড

    হ্যাঁ

    ক্ষেত্র বিশেষে

    হ্যাঁ

    না

    ক্ষেত্র বিশেষে

    হ্যাঁ

    ক্ষেত্র বিশেষে

    হ্যাঁ

    ত্রেকার্তিস্তা

    না

    ক্ষেত্র বিশেষে

    ক্ষেত্র বিশেষে

    না

    ক্ষেত্র বিশেষে

    না

    ক্ষেত্র বিশেষে

    ক্ষেত্র বিশেষে

    রমডয়টার

    হ্যাঁ

    ক্ষেত্র বিশেষে

    ক্ষেত্র বিশেষে

    ক্ষেত্র বিশেষে

    হ্যাঁ

    হ্যাঁ

    হ্যাঁ

    ক্ষেত্র বিশেষে

     

    একজন রমডয়টারের সকল সুবিধাগুলো আদায় করে নিতে একটি দলের অ্যাটাকিং থার্ডে দক্ষ ইনসাইড ফরোয়ার্ড, ত্রেকার্তিস্তা এবং উইং ব্যাকদের সাপোর্ট থাকাটা জরুরী। যেমন যদি একজন ইনসাইড ফরোয়ার্ড চ্যানেল পরিবর্তন করে প্রতিপক্ষের বক্সের দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে রমডয়টার তার বিবেচনা অনুযায়ী আরো এগিয়ে গিয়ে তাকে সাপোর্ট দিতে পারে বা ওয়াইড পজিশনে সরে আসতে পারে। আবার রমডয়টার যদি ন্যারো চ্যানেলে (বক্সের দিকে) সরে আসতে চায়, তবে দলের উইং ব্যাক এবং ত্রেকার্তিস্তা তাদের পজিশন পরিবর্তন করে উইং এবং চ্যানেলের পেছনে তাকে সাপোর্ট দিতে পারে। মোদ্দা কথা, বায়ার্ন বা বার্সার মতো যেসকল দলে আক্রমণভাগে বহুমুখী প্রতিভারা আছেন, সেখানে একজন রমডয়টার অ্যাটাকিং থার্ডে যেকোন পজিশনের সাপোর্ট দিতে পারেন। আর যেহেতু তার কোন বাঁধাধরা পজিশন নেই, তাই তাকে মার্ক করা বা সার্বক্ষণিক নজরে রাখাটা প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের জন্য বেশ একটা ঝামেলার কাজ হয়ে যায়। এবং এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে একজন রমডয়টার চ্যানেলের মাঝে এগিয়ে পিছিয়ে নিজের এবং নিজের দলের অন্যান্য অ্যাটাকারদের জন্য ‘স্পেস’ তৈরী করে দিতে পারেন। ২০১২-'১৩ মৌসুমে ডুসেলডর্ফের বিপক্ষে একটি ম্যাচে মুলারের মাঠে পদচারণার একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে রমডয়টারকে স্বাধীনতা দিলে তিনি কি করতে পারেন। ঐ ম্যাচে মুলার ২টি গোল এবং ১টি অ্যাসিস্ট করেন।

     

    রমডয়টারের ফ্রি রোমিং দক্ষতা

     

    রমডয়টারের কি কি দক্ষতা প্রয়োজন?

    একজন রমডয়টারের কি কি গুণ প্রয়োজন? এর উত্তর, সব! একজন ‘শূন্য সন্ধানী’কে প্রয়োজনমতো ‘ওয়াইড পোচার’, ‘ইনসাইড ফরোয়ার্ড’ বা “আউট অ্যান্ড আউট ফরোয়ার্ড” হিসেবেও খেলতে হতে পারে খেলার গতিপ্রকৃতির বিচারে। কাজেই একজন প্রকৃত রমডয়টারের ফিনিশিং হতে হবে একজন প্রকৃত ফরোয়ার্ড বা পোচারের মতো। ২০১২-'১৩ মৌসুমে মুলারের শ্যুটিং পরিসংখ্যান (২৫টি ম্যাচে ৩২টি অন টার্গেটে শট এবং ১৩টি গোল) দেখলেই ব্যাপারটা ভাল বোঝা যাবে।

     

    রমডয়টারের শুটিং দক্ষতা

     

    পজিশনিং সেন্স একজন শূন্য সন্ধানীর তূণে থাকতেই হবে। যেহেতু বেশরভাগ সময়েই রমডয়টার অ্যাটাকিং পজিশনেই খেলবেন, কাজেই জায়গামতো উপস্থিত থেকে বলকে জালে ঢোকানাও তাই তাঁর মূল দায়িত্ব। আর যেহেতু প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা বারবার পজিশন চেঞ্জ করার দরুণ তাকে মার্ক করতে সহজে পারবে না, সেই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করে দলের এবং নিজের গোলসংখ্যা বাড়ানোটা খুব একটা শক্ত কাজ না(আপাতদৃষ্টিতে!!)।

     

    পজিশনিং সেন্স, একজন শূন্য সন্ধানীর প্রয়োজনীয় গুণ

     

    একজন শূন্য সন্ধানীর আরেকটি বড় বিশেষত্ব হল, তার আনপ্রেডিক্টিবিলিটি। তার দৌড়ের বিক্ষিপ্ত প্যাটার্নের কারণে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ তাঁর নাগালে আসতে পারবে না। আক্রমণভাগে ইতস্তত ছুটোছুটি করে রমডয়টার সবসময় শুন্যস্থানের খোঁজে থাকবেন এবং সুযোগ পেলেই দৌড়ে প্রতিপক্ষের ব্যাক লাইনের পেছনে চলে গিয়ে গোল দেওয়ার সুযোগ তৈরী করবেন। মেইঞ্জের বিপক্ষে এই ম্যাচে মুলারের রান লক্ষ্য করুন, রবেন বল রিসিভ করার আগেই মুলার তাঁর দৌড় শুরু করে দিয়েছেন এবং সেটা ডিফেন্ডারের ভেতরের চ্যানেল দিয়ে!

     

    রমডয়টারের 'আনপ্রেডিক্টেবল' রানিং

     

    যেহেতু রমডয়টারের পজিশন পরিবর্তন করার স্বাধীনতা আছে, তিনি প্রয়োজনে নিচে নেমে ‘বক্স টু বক্স’ সাপোর্টও দিতে পারেন। এক্ষেত্রে তাঁর গতি এবং খেলার গতি-প্রকৃতি বুঝে জায়গামতো পৌঁছে যাওয়ার গুণটা বেশি জরুরী। যেমন ২০১২-'১৩ এর চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে বার্সার জর্ডি আলবার বিপক্ষে মুলারের এই পারফেক্ট ব্লক দেখলে কে বিশ্বাস করবে, হ্যাংলা পাতলা মুলারের দ্বারা এই কাজ সম্ভব?

     

    মুলারের 'ব্লকিং'

     

    এবং সর্বোপরি একজন রমডয়টারের সবচেয়ে বড় গুণ, যেটার কারণে এই নামকরণঃ ফাঁকাস্থান বের করা এবং দূরদৃষ্টি। বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিপক্ষের রক্ষণের উপরে-নিচে ঘোরাঘুরি করে তিনি স্পেস বের করার চেষ্টা করবেন, যাতে তার দলের রেজিস্তা বা প্লেমেকাররা লম্বা বল বা ডিফেন্স চেরা থ্রু বের করে দিলে জায়গামতো পৌঁছে সেটা জালে জড়ানোর প্রথম দাবীদার তিনিই হন।  

     

    রমডয়টারের 'স্পেস' সৃষ্টি

     

    রমডয়টারের বিবর্তন

    মুলারের একজন শূন্য সন্ধানী হিসেবে বিকশিত হওয়ার পেছনে আছেন ফুটবল বিশ্বে কিংবদন্তীতে পরিণত হওয়া কিছু ম্যানেজার। লুই ভ্যান হাল, ইউপ হেইংকেস, পেপ গার্ডিওলা এবং ইওয়াকিম লো। এদের প্রত্যেকেরই ফুটবলের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী এবং ফুটবল দর্শন ছিল ভিন্ন। তবে এদের মাঝে একটা মিল ছিল, এরা প্রত্যেকেই গতিময় ফুটবল এবং ফ্লুইড ফর্মেশনে বিশ্বাসী। এদের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার কারণেই থমাস মুলার বিশ্বকে নিজের 'শূন্য সন্ধানী' প্রতিভা ভালভাবে চিনিয়ে দিতে পেরেছেন।

     


    আরও পড়ুন:

    ট্যাকটিকসের হাতেখড়ি ২- গ্রেগেনপ্রেসিং


     

    ক) ভ্যান হাল আমলঃ

    ২০০৯-’১০ মৌসুমে মুলার যখন বায়ার্নের যুব দল থেকে মূল স্কোয়াডে যোগ দিলেন, তখন সবাই এমনকি মুলারও নিশ্চিত ছিলেন যে বায়ার্নের প্রথম একাদশে জায়গা করে নিতে তার অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। যুব দলে মুলার খেলতেন একজন উইঙ্গার হিসেবে আর সেই সময়ে বায়ার্নের দুই উইংয়ে খেলেন রিবেরি এবং রবেন, বিশ্বের সেরা দুইজন উইঙ্গার, কাজেই বায়ার্নের হয়ে ধারে অন্য দলে খেলে খেলে নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে, এটা মুলার প্রায় ভবিতব্যই ধরে নিয়েছিলেন। তবে ঐ মৌসুমে বায়ার্নের দায়িত্ব নিয়েছেন লুই ভ্যান হাল, ঐ কুড়ি বছরের হ্যাংলা পাতলা তরুণ খেলোয়াড়টির মাঝে নিশ্চয়ই কিছু একটা দেখতে পেয়েছিলেন ডাচ কোচ। নয়তো এর আগের মৌসুমে মাত্র ৫টি ম্যাচ খেলা মুলারকে কেন তিনি এরকম রত্নখচিত দলে ৫২টি ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দেবেন?

    ঐ মৌসুমের শুরুতে ভ্যান হাল কৌশল নিয়ে বেশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। তিনি শুরু করেছিলেন স্ট্যান্ডার্ড ৪-৪-২ ফর্মেশন দিয়ে। তারপর রিবেরি, রবেন, ক্লোসা/গোমেজকে জায়গা করে দিতে তৈরী করা হল ৪-৩-৩ ফর্মেশন। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ‘তারকা’কে জায়গা করে দিতে ভ্যান হাল ৪-৩-২-১ এমনকি ৩-৩-৩-১ এর মতো বিজাতীয় ফর্মেশনেও খেলেছে বায়ার্ন। এবং নিয়মিত প্রায় প্রতিটি ম্যাচে মুলারকে খেলানোর কারণে মুলারের ‘শূন্যসন্ধানী’ গুণের আভাস পেয়েছেন ভ্যান হাল। সব ধরনের ফর্মেশনেই মুলার নিজের জায়গা করে নিয়েছেন, কখনো মারিও গোমেজের পেছনে সেকেন্ড স্ট্রাইকার হিসেবে কিংবা রোবেন ফিট না থাকলে উইংয়ে বা ফলস নাইন হিসেবে।

    মুলারের কার্যকারিতার প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় ওই মৌসুমেই। শেষ পর্যন্ত অনেক অ্যালোপ্যাথি-হোমিওপ্যাথির পর ভ্যান হাল নিরাময় হিসেবে আবার সেই পুরনো ৪-৪-২ ফর্মেশনেই ফিরে যান মৌসুমের দ্বিতীয় অর্ধে। ভ্যান হাল অভিজ্ঞ গোমেজ এবং ক্লোসার ওপর আর ভরসা না করে ফরোয়ার্ড লাইনের দায়িত্ব দিলেন ইভিকা অলিচ এবং মুলারকে। গোমেজ এবং ক্লোসা চমৎকার ফিনিশার হলেও দলের সাথে লিংক আপ খেলাগুলো বুঝে উঠতে তাঁদের বেগ পেতে হচ্ছিল - যেটা ভ্যান হালের মনঃপুত হয় নি মোটেও।

    এর আগে কোনো কারণে যদিওবা ফরোয়ার্ডদের ফর্ম খারাপ যেত,  তখন বায়ার্নের মুখস্থ খেলা ছিল বল রিবেরি বা রোবেনকে ছেড়ে দেওয়া, তাঁরা কিছু করতে পারবেন এই আশায়। কিন্তু যেকোন বুদ্ধিমান প্রতিপক্ষ খুব সহজেই এই কৌশলকে ফর্দাফাই করে দিতে পারবে খুব একটা মাথা না খাটিয়েই। অলিচ-মুলার জুটির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাদের প্রয়োজন মতো সামনের যেকোন পজিশনে খেলতে পারার দক্ষতা। এই নতুন কৌশলে বায়ার্নের খেলা তাদের নিজেদের জন্য বিথোভেনের সুরের মতোই সাবলীল, কিন্তু প্রতিপক্ষের কাছে জার্মান ভাষার মতোই জটিল রূপ ধারণ করে।   

     

    ভ্যান হালের ফর্মেশনে মুলার

     

    খ) ইউপ হেইংকেস আমলঃ

    মুলারের প্রতিভা সবার আগে হয়তো ধরতে পেরেছেন ভ্যান হাল, কিন্তু সবচেয়ে দক্ষভাবে এই প্রতিভার ব্যবহার করে গিয়েছেন বায়ার্নের পরবর্তী ম্যানেজার ইউপ হেইংকেস। হেইংকেসের বেইস ফর্মেশন ছিল ৪-২-৩-১; তবে বল মাঠে গড়ালে সেটা খেলার অবস্থা বুঝে ৪-৪-১-১ বা ৪-৪-২ হয়ে যেত। দুই উইংয়ে রোবেন এবং রিবেরি ছিলেন ইনভার্টেড উইঙ্গারের ভূমিকায়, তাঁদের কাজ ছিল ওয়াইড চ্যানেল থেকে ভেতরে ঢুকে গোলে শট নেওয়া। ওদিকে সামনে মারিও মানজুকিচ এবং থমাস মুলার নিজেদের পজিশন পরিবর্তন করে নিতেন খেলার গতি অনুযায়ী।

    বল হারালে হেইংকেসের বায়ার্ন প্রেসিং করতো, কিন্তু সেটার ধরণ অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা ছিল। মাঝমাঠে বলের দখল হারালে রিবেরি এবং রবেন পিছিয়ে মিডফিল্ডারদের লাইন বরাবর দাঁড়াতেন এবং মানজুকিচ -মুলার প্রেস করতেন প্রতিপক্ষের প্লেমেকারদের। প্রতিপক্ষ যদি বল নিয়ে উইং দিয়ে আগানোর চেষ্টা করে, তবে প্রেসিং করার দায়িত্ব ছিল উইং ব্যাক - রিবেরি বা রবেন এবং মুলারের।

    এরকম একটা ফ্লুইড সিস্টেমে মুলারের আসল প্রতিভা আরো বিকশিত হতে থাকে। হেইংকেসের প্রথম মৌসুমে (২০১১-’১২) মুলারের প্রথম একাদশে জায়গা করে নিতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল, তবুও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোল করে (চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালসহ) এবং বেঞ্চ গরম করেও পুরো মৌসুমে ১১ গোল করার পর হেইংকেস মুলারকে প্রথম একাদশের অংশ করে নেন। মুলারও ২০১৭ সাল পর্যন্ত বায়ার্নের সাথে চুক্তি নবায়ন করেন। এবং পরবর্তী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে বার্সার বিপক্ষে দুই লেগ মিলিয়ে তিনটি গোল এবং একটি অ্যাসিস্ট করেন। ডিএফবি পোকালের ফাইনালেও গোল করেন মুলার। ঐ মৌসুমে সর্বমোট ২৩ গোল ছিল মুলারের আর সেই সাথে দলের ট্রফি ক্যাবিনেটে যোগ হয় অবিস্মরণীয় ট্রেবল। সব মিলিয়ে ২২ বছর বয়সেই মুলার উঠে যান অন্যরকম উচ্চতায়।

     

    হেইংকেসের ফর্মেশনে মুলার

     


    আরও পড়ুন:

    ট্যাকটিকসের হাতেখড়ি ১- কাতেনাচ্চিওর কূটকৌশল


     

    গ) গার্ডিওলা আমলঃ

    গার্ডিওলার আমলের শুরুতে পেপ মিডফিল্ডার দিয়ে দল বোঝাই করে ফেলতে থাকেন। পেপ ধীরে ধীরে লাম, আলাবা, মার্টিনেজদের বহুমুখী প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে ফিক্সড ফর্মেশনের ধারণাকে ধুলিস্যাৎ করে দেন।

    গার্ডিওলার অধীনে বায়ার্ন শুরুতে ৪-৩-৩ বা ৪-১-৪-১ ধরনের ফর্মেশনে খেললেও সেটা বিভিন্ন সময়ে ৩-৪-৩ এর বিভিন্ন রকমফেরের দিকে চলে যায়। এখন পর্যন্ত বায়ার্ন  ২-৩-২-৩, ৩-৩-৩-১, ৩-৩-৪ এমনকি ২-৩-৩-২ এর মতো অনেক অদ্ভূত ফর্মেশনেও খেলেছে; কিন্তু মুলারের মতো আরো এক ঝাঁক 'মাল্টি ট্যালেন্টেড' ফুটবলারের দল হিসেবে বায়ার্নকে গড়ে তোলার কারণে এই ধারণাটা খেটে গেছে প্রায় প্রতিবারই।

    পেপের অধীনে মুলার সামনে গ্যোৎজে, মানযুকিচ, লেফানডফস্কির পাশাপাশি খেলেছেন, আবার খেলেছেন রমডয়টার হিসেবেও। এমনকি তাকে একা স্ট্রাইকার হিসেবেও বার কতক খেলানো হয়েছে। দলের ম্যানেজার এবং দর্শনের পরিবর্তন অবশ্য মুলারের খেলায় তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারে নি। মুলার মৌসুম শেষ করেন ২৭টি গোল নিয়ে।

     

    পেপ গার্ডিওলার ফর্মেশনে মুলার

     

    ঘ) ইওয়াকিম লো আমলঃ

    মুলারের সৌভাগ্যই বলতে হবে কারণ ওদিকে জার্মান জাতীয় দলেও ইওয়াকিম লো ৪-২-৩-১ বা ৪-১-৪-১ এ খেলাতে শুরু করেন। মুলারের জায়গা হয় মিরোস্লাভ ক্লোসার ডানে ওয়াইড ফরোয়ার্ড হিসেবে। কিন্তু ক্রমেই জার্মান দলেও মুলারের রমডয়টার রোলের মাহাত্ম্য বুঝে লো তাকে বাড়তি স্বাধীনতা দেন চ্যানেল সুইচ করার। ২০১০ বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই তাঁর আন্তর্জাতিক গোলের খাতা খোলেন মুলার। বিশ্বকাপ শেষ করেন ৫ গোল করে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোল স্কোরারের গোল্ডেন বুট এবং সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের ট্রফি নিয়ে। লো বুঝতে পারেন, তরুণ মুলারকে মাইকেল বালাক কিংবা জার্ড মুলারের ১৩ নং জার্সি দেওয়াটা অবিচার হয় নি। ২০১৪ বিশ্বকাপে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে মুলারের কাছ থেকে আবারও আসে ৫টি গোল।

     

    লো'র ফর্মেশনে মুলার

     

    রমডয়টারের ভবিষ্যত

    রমডয়টার ব্যাপারটা অনেক ম্যানেজারই বিলাসিতা হিসেবে দেখেন। খোদ ইউপ হেইংকেস, ইওয়াকিম লো বা গার্ডিওলাই অনিশ্চিত ছিলেন যে তাদের দলে এরকম একটা ফ্রি রোমিং রোল রাখার বিলাসিতা করা যায় কিনা, কিন্তু থমাস মুলার নিজের খেলার মাধ্যমে তাঁদের মত পরিবর্তন করেছেন। সত্যি বলতে কি, বর্তমান ফুটবল বিশ্বে দলে রমডয়টার রাখার মতো যোগ্যতা আছে এরকম দল হাতেগোণা কয়েকটিই। বায়ার্ন বা বার্সেলোনা বা আয়াক্স - যেসব দল কাঠামোবদ্ধ প্রথাগত ফর্মেশনে না খেলাটাকেই পছন্দ করে, কেবলমাত্র সেসব দলের দর্শনেই একজন রমডয়টারকে জায়গা করে দেওয়া সম্ভব। একজন রমডয়টারকে হতে হবে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী যেটা আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কিন্তু শুধু তাতেই যথেষ্ট হবে না। দলের আক্রমণভাগের অন্যান্য খেলোয়াড়দেরও কমবেশি নিজেদের রোল এবং চ্যানেল পরিবর্তন করে খেলার মতো দক্ষতা থাকতে হবে বা অর্জন করে নিতে হবে, যেটা পুরোপুরি দলের ম্যানেজারের ফুটবল দর্শনের ওপর নির্ভর করে। সর্বোপরি রমডয়টার রোলে খেলবার জন্য যেসকল বিশেষ গুণাবলীর সমন্বয় প্রয়োজন তা কেবল বিশ্বের গুটিকতক প্রথম সারির ফুটবলারদের মাঝেই দেখা যায়। মেসি, রোনালদো, নেইমার, সুয়ারেজ, হ্যাজার্ড, ডি ব্রুইন, হামেস রদ্রিগেজদের মতো কিছু খেলোয়াড়দেরই কেবল রমডয়টার হিসেবে খেলবার যোগ্যতা আছে বা যোগ্যতা তৈরী করে নেওয়া সম্ভব। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে সারা বিশ্বে রমডয়টারের একমাত্র বিজ্ঞাপন বায়ার্ন মিউনিখ এবং একমাত্র রোল মডেল থমাস মুলারই থাকবেন। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে কোন কুশলী ম্যানেজার এই রোলটির আরো কিছু বিবর্তন সাধন করে আপামর জনসাধারণ (বা ফুটবল ক্লাবগুলির) মাঝে ব্যাপারটিকে জনপ্রিয় করে তুলবেন।

     

    শেষ করি একটু হাল্কা মেজাজে। শূন্যস্থানের ফেলুদা বা ব্যোমকেশ যা-ই হন না কেন, মুলারের জনপ্রিয়তা কিন্তু মেসি-নেইমারের থেকে একটু ভিন্ন জাতের। খেলোয়াড়, কোচ, ম্যানেজার, ব্যাকরুম বা মেডিকাল স্টাফ হতে শুরু করে সকলের কাছেই মুলারের জনপ্রিয়তা খুবই তুঙ্গে। রাশভারী লুই ভ্যান গাল তো একসময় ঘোষণাই দিয়ে বসেছিলেন, "আমি যেখানে যাব মুলারও সেখানেই যাবে, এমনকি আমি অবসর নেওয়ার পরও।” বুঝুন তাহলে মুলার কেমন জনপ্রিয় তার নিজের মানুষদের মাঝে?

     

    দলের সিনিয়র সদস্যদের সাথে দুষ্টুমি করার অধিকার একমাত্র মুলারের!!

     

    মুলারের সাথেও দুষ্টুমি করার অধিকার বাকি সবার!!

     

    একমাত্র মুলারের জন্যই পেপ নেচে দেখান!!

     

    অতীতে পিরলো, ক্রুইফ, জাভি, রোবেন, মেসি-রা ফুটবলের একেকটা নতুন নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছেন। মুলারের এই রমডয়টারের ধারণাটাও সেই পথেই যাবে বলে আমি মনে করি। এমন দিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন কোন ধারাভাষ্যকার কোনো তরুণের খেলা দেখে বলে উঠবেন, "এই ছেলেটা ভালই - রমডয়টারের একটু ধীরস্থির ভার্সন!"

    আর কেনো আমি মনে করি, মুলারের এই রোল মুলারের দেওয়া নামেই টিকে থাকবে? কারণ মুলার এমন সব কান্ড পিচে করেন যা অনেক সময় ব্যাখ্যা করা দুষ্কর। তাঁর মতো খেলোয়াড় আগামীতে হয়তো ফুটবল মাঠে দেখা যাবে, তবে আপাতত মুলারই একমাত্র, একা "ডার রমডয়টার"!