• " />

     

    ক্রিকেটের ডোপপাপীরা

    ক্রিকেটের ডোপপাপীরা    

    সেই ১৯৯৫ সালে সাবেক অস্ট্রেলিয়ান পেসার মাইক হুইটনি ধরা পড়েছিলেন ‘ক্যানাবিস’ সহ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের ড্রাগ সংশ্লিষ্টতার বোধহয় প্রথম ঘটনা। এরপর শেন ওয়ার্ন, প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে যাঁকে ড্রাগ-সংশ্লিষ্ট কারণে নিষিদ্ধ করা হয়। ক্রিকেটকে নাড়িয়ে দেওয়া সেরকমই কিছু ডোপ-‘পাপী’দের কাহিনী.....

     

    শেন ওয়ার্ন (অস্ট্রেলিয়া)
    ২০০৩

     

    জানুয়ারি, ২২। ২০০৩। পরদিন ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভিবি সিরিজের প্রথম ফাইনাল। শেন ওয়ার্ন কাঁধের দীর্ঘ এক চোট কাটিয়ে ফিরছেন এ ম্যাচ দিয়েই। ফেরার আগে সংবাদ সম্মেলনে আরেকটা ঘোষণাও দিলেন স্পিন-জাদুকর। কদিন পর অনুষ্ঠিতব্য দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ দিয়েই ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিবেন। এই সংবাদ সম্মেলনটাই যে ওয়ার্নকে বিশ্বকাপ খেলতে দিবে না, তখন কে জানতো!

     

    ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী জেমস সাদারল্যান্ড জানালেন, শেন ওয়ার্ন বিশ্বকাপ না খেলার ‘ইচ্ছা’ পোষণ করেছেন। কারণ? যেদিন সংবাদ সম্মেলন করে ওয়ার্ন অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেদিনই অস্ট্রেলিয়ার ‘নিয়মিত ডোপ টেস্টে’ নমুনাও জমা দিয়েছিলেন। ‘পজিটিভ’ প্রমাণিত হয়েছেন সেখানেই! তাঁর নমুনায় ‘ডাইয়ুরেটিকস’ এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এটি নিজে পারফরম্যান্স- বর্ধক ড্রাগ নয়, তবে এর উপস্থিতিতে ছাপিয়ে যেতে পারে ‘অ্যানাবলিক স্টেরয়েড’ এর মতো ড্রাগের প্রভাবও! শেন ওয়ার্ন পরে জানিয়েছিলেন, সেদিন ওই সংবাদ সম্মেলনের আগে তাঁর মা তাঁকে একটি পিল দিয়েছিলেন, যেটি নিলে নাকি টিভি ক্যামেরার সামনে ভাল দেখাবে তাঁকে! ‘ভদ্র’ ছেলের মতো তা নিয়েছিলেন ওয়ার্ন!

     

    বিশ্বকাপ থেকে গিয়ে ট্রাইবুনালের মুখোমুখি হয়ে দুই বছরের জন্য শুরুতে নিষিদ্ধ হন ওয়ার্ন। তবে পারফরম্যান্স বর্ধক ড্রাগের উপস্থিতি না থাকায় শাস্তি কমে আসে ১২ মাসে। পরে অবশ্য ওয়ার্ন স্বীকারও করে নেন, এরকম ‘ডাইয়ুরেটিকস’ এর আগেও দুইবার নিয়েছিলেন তিনি! ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বরের এক পরীক্ষায় তাঁর নমুনায় ‘সামান্য’ ড্রাগের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল, তবে তা ‘পজিটিভ’ প্রমাণিত হওয়ার জন্য নাকি ‘যথেষ্ট’ ছিল না। সে সময় অনেকগুলো ওয়াইনের প্রচারণাই অংশ নিয়েছিলেন ওয়ার্ন, সুতরাং পানও করেছিলেন নাকি ‘একটু বেশীই’! সে কারণেই নাকি তাঁর মা ‘ওজন কমাতে’ দিয়েছিলেন সে ড্রাগ। অনেকেই ওয়ার্নের মাকেও একহাত নিয়েছিলেন, ছেলেকে এমন ‘নিষিদ্ধ উপাদান’ সেবন করার ‘উৎসাহ দেয়ায়’। তবে ওয়ার্ন বলেছিলেন, ‘আমার মুখ দিয়ে ভেতরে কী যায়, তার সব দায়দায়িত্ব একা আমার’।

     

    বিশ্বকাপ খেলে আর ওয়ানডেকে বিদায় বলা হয়নি তাই ওয়ার্নের। অস্ট্রেলিয়াও বিশ্বকাপ জিতেছিল তাঁকে ছাড়াই। নিষিদ্ধ হওয়ার পরই অবসর নেন, পরে অবশ্য এশিয়া একাদশের সঙ্গে একটি ম্যাচ খেলেছিলেন বিশ্ব একাদশের হয়ে।

     

    শোয়েব আখতার ও মোহাম্মদ আসিফ (পাকিস্তান)
    ২০০৬

     

    বব উলমার তখন পাকিস্তানের কোচ। তাঁরই নির্দেশে পাকিস্তান প্রথম ডোপ টেস্ট করালো ক্রিকেটারদের। উলমার যদি জানতেন, এই ডোপ টেস্টই দলের সেরা দুই পেসারকে কেড়ে নিবে তাঁর! আইসিসির ‘অ্যান্টি ডোপিং পলিসি’-র অধীনে ১৯ জন ক্রিকেটারের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হলো নিকটবর্তী ওয়াডা (ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি ডোপিং এজেন্সি) এর পরীক্ষাগারে, মালয়েশিয়ায়। ফল এলো, দুজন ক্রিকেটারের শরীরে নিষিদ্ধ ‘অ্যানাবলিক স্টেরয়েড’ ‘ন্যানড্রোলন’-এর উপস্থিতির বার্তা নিয়ে। শোয়েব আখতার ও মোহাম্মদ আসিফ। তখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে ভারতে পাকিস্তান। পরদিন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে প্রথম ম্যাচ। ‘ওভাল কান্ড’তে তখন এমনিতেই টালমাটাল দলটি, অধিনায়ক ইনজামাম উল হক ‘নিষিদ্ধ’, তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনে ‘নাটক’ তখন চরমে! ইউনুস খান বলে বসেছিলেন, তিনি ‘পুতুল’ অধিনায়ক হবেন না! শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচটা অবশ্য জিতেছিল পাকিস্তান।

     

    শোয়েব ও আসিফ পরে দেশে ফিরে ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি হলেন। শোয়েবকে দুই বছর, আসিফকে এক বছর নিষিদ্ধ করলো সে ট্রাইব্যুনাল। শোয়েব আর আসিফের আবেদনের প্রেক্ষিতে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলো, যেখানে তাঁদের শাস্তি একেবারেই মওকুফ করা হলো! পরের ট্রাইব্যুনাল বলেছিল, আগের ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছে ওয়াডার নিয়ম মেনে, যা আসলে হওয়া উচিৎ পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের নিজস্ব নিয়মে! সাজা মওকুফের পেছনের কারণ হিসেবে সে ট্রাইব্যুনাল আরও বলেছিল, শোয়েব ও আসিফদের যে ‘প্রোটিন’ সরবরাহ করা হয়েছিল বোর্ডের তরফ থেকে, সেখানে যে ‘ন্যানড্রোলন’ এর উপস্থিতি ছিল, দুই পেসার তা জানতেন না!

     

    ওয়াডা পিসিবির এমন সিদ্ধান্তকে ‘অনুচিত’ বলে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতেও। সেখানে তাঁরা আইসিসির সমর্থনও পায়। তবে পিসিবি ‘থোড়াই কেয়ার’ করে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে পরবর্তী সিরিজেই দলে নিয়েছিল আসিফকে। শোয়েব চোটে পড়ায় দলে ছিলেন না, তবে পরে চোটের কবলে পড়া উমর গুলের স্থলাভিষিক্ত হয়ে উড়ে গিয়েছিলেন। পরের বছর ক্যারিবীয় বিশ্বকাপের ১৫ জনের দলেও ছিলেন দুই পেসার। তবে শেষ মুহুর্তে দুজনকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়, ‘চোটের’ কারণ দেখিয়ে। আসলে মনে করা হচ্ছিল, পিসিবির আশঙ্কা রয়ে গেছে, শোয়েব আর আসিফের শরীরে তখনও ওই ‘ন্যানড্রোলন’ এর উপস্থিতি আছে! আর ওদিকে আইসিসিও বলেছিল, তাদের অধিকার আছে, যে কোনো ক্রিকেটারের ডোপ টেস্ট করানোর!

     

    মোহাম্মদ আসিফ (পাকিস্তান)
    ২০০৮

     

    আইপিএল খেলে পাকিস্তানে ফেরার পথে দুবাইতে ‘ধরা’ পড়েন পাকিস্তানি পেসার। অপরাধ, তাঁর ওয়ালেটে পাওয়া গেছে ‘নিষিদ্ধ’ বস্তু! ১৯ দিন দুবাই বিমানবন্দরের হেফাজতে থাকার পর মুক্তি পান আসিফ, তাঁর বিরুদ্ধে সকল অভিযোগও তুলে নেয়া হয় ‘পর্যাপ্ত প্রমাণ’ না থাকার কারণে। অবশ্য আরব আমিরাতে তাঁর ভবিষ্যত প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড এসময় যথেষ্ট সাহায্যও করেছিল এ পেসারকে। আসিফ বলেছিলেন, আইপিএলেও তিনি দুইটি ডোপ টেস্টে অংশ নিয়েছেন। জেনেশুনে তিনি কখনোই নিষিদ্ধ কোনো বস্তু সেবন করেননি। তবে দেশে ফিরেই ‘দুঃসংবাদ’টা পান আসিফ। আইপিএলের ওই ডোপ টেস্টেই একমাত্র ক্রিকেটার তিনি, যাঁর শরীরে নিষিদ্ধ ড্রাগের উপস্থিতি পাওয়া গেছে! 

     

    পিসিবি এবার পাশে ছিল না আসিফের, এক বছর বরং নিষিদ্ধই করেছিল।

     

    উপুল থারাঙ্গা (শ্রীলংকা)
    ২০১১

     

    বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে শ্রীলঙ্কার ওপেনারের শরীরে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত বস্তুর উপস্তিতি পেয়েছিল আইসিসি। তবে থারাঙ্গা দোষ স্বীকার করে নিয়েছিলেন, আইসিসিও মেনে নিয়েছিল যে তিনি ইচ্ছাকৃত অপরাধ করেননি। তিন মাসের নিষেধাজ্ঞার শাস্তিতেই তাই পার পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

     

    কুশল পেরেরা (শ্রীলংকা)
    ২০১৫

     

    ডিসেম্বরের শুরুতে ডোপ টেস্টে ‘পজিটিভ’ প্রমাণিত হয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান। দ্বিতীয় নমুনাতেও ‘পজিটিভ’ প্রমাণিত হয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চলতি সফর থেকে প্রত্যাহারও করে নেয়া হয়েছে তাঁকে। আইসিসি অবশ্য এখনও তাঁর শাস্তির মেয়াদ ঘোষণা করেনি, তবে চার বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হতে পারে তাঁকে।

     

    ইয়াসির শাহ্‌ (পাকিস্তান)
    ২০১৫

     

    ক'দিন আগেই শেন ওয়ার্ন বলেছিলেন, ইয়াসির শাহের মাঝে নিজেকে দেখেন তিনি! স্পিন-জাদুকর বোলিংয়ের কথাই বলেছিলেন, তবে তখন যদি জানতেন কদিন পরই তাঁর মতো করেই ডোপ টেস্টেও ‘পজিটিভ’ হবেন ইয়াসির! শেষ ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজে ইয়াসিরের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, যে সিরিজে চোট কাটিয়ে ফিরেছিলেন তিনি। নিষিদ্ধ ‘ডাইয়ুরেটিকস’ ‘ক্লোরটেলিডন’ এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে তাঁর শরীরে। আপাতত সব ধরণের ক্রিকেট থেকেই সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে পাকিস্তানি লেগস্পিনারকে। দ্বিতীয় নমুনা পরীক্ষার আবেদন করতে পারবেন তিনি, সেখানে ‘নেগেটিভ’ প্রমাণিত হলে সব ধরনের ‘নিষেধাজ্ঞা’ই তুলে নেয়া হবে সঙ্গে সঙ্গেই। তবে সেখানেও ‘পজিটিভ’ প্রমাণিত হলে, ওয়ার্নের মতো নাকি তার চেয়েও বেশী শাস্তি অপেক্ষা করে আছে, সময়ই বলবে!