• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১৫
  • " />

     

    ২২ গজের সেলুলয়েডঃ মিরপুরের অবাক আনন্দ

    ২২ গজের সেলুলয়েডঃ মিরপুরের অবাক আনন্দ    

     

    ছবির পরে ছবি চলে নাকি তৈরী হয় সিনেমা। ক্রিকেট ম্যাচও তো তাই। টুকরো টুকরো অসংখ্য ছবি জন্ম নেয় যেখানে। ২২ গজ আর সবুজ ওই উদ্যানের ছবিগুলোকে যদি ধরা যেত সেলুলয়েডে!

    মিরপুরে কাল পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ। তারই কিছু ছবি-

     

     

     

    আহা কী আনন্দ!

    “আয়েশ করে আলসেমিতে দশটি বছর পার
    ভাল্লাগেনা আর!”

    সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজা দেশে সিনেমার একটা সংলাপ। প্রায় দশবছর যাবত রাজপ্রাসাদের বিলাসিতায় বন্দি হয়ে তাদের অপেক্ষা, মুক্ত আকাশের নীচে ঘুরে বেড়ানোর। না বাংলাদেশ পাকিস্তানকে না হারিয়ে এ ১৬ বছর আয়েশ করেনি। আলসেমিরও সুযোগ ছিল না। তবে অপেক্ষা বাড়ছিল। সুতীব্রও হচ্ছিল আকাঙ্ক্ষা। তারপর সেদিন এলো। ১৬ বছর বাদে। একদিন বিরতি দিয়ে আবার। মিরপুরে ১৬ বছর পরের ইতিহাস বদলে গেল গতকাল।

    গুপি আর বাঘার মতো করে তাই গাওয়াই যায়, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’! অবশ্য ক্রিকেটারদের উল্লাসের মাত্রাটা ছিল পরিমিত। যেন হরহামেশাই ঘটে এমন ইতিহাস! এই পরিমিতবোধ তো পরিনতবোধেরই পরিচায়ক!

     

     

    মাশরাফির ১৫০ আর মনির ৫০

    মাশরাফি বিন মর্তুজা মিরপুরে কাল খেললেন নিজের দেড়শতম ওয়ানডে। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশী খেলা ওয়ানডের তালিকায় সবার ওপরে মোহাম্মদ আশরাফুল (১৭৫)। তারপরে আছেন আব্দুর রাজ্জাক (১৫৩)। সাকিব আল হাসান ১৪৯টি ওয়ানডে খেলেও মাশরাফির ওপরে! কিভাবে? মাশরাফি যে ২০০৭ সালে আফ্রো-এশিয়া কাপে এশিয়া একাদশের হয়ে খেলেছিলেন দুটি ওয়ানডে। দেড়শতম ওয়ানডে খেলার কাছাকাছি আছেন মুশফিকুর রহিমও (১৪৮)।


    কাল একটি মাইলফলক ছুঁয়েছেন এনামুল হক মনিও। সাবেক এই স্পিনার কাল নেমেছিলেন আম্পায়ারিংয়ের ৫০তম ম্যাচে। ২০০৬ সালে বগুড়ায় বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হয়েছিল মনির। ২০১২ সালে ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্টে আম্পায়ারিং করেছিলেন তিনি, নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের নেপিয়ার টেস্টে। মনির এই আম্পায়ারিং মাইলফলকটি হলো আবার একটি বিশেষ দিনে। কালই যে জন্মদিন ছিল প্রখ্যাত ইংলিশ আম্পায়ার ডিকি বার্ডের!

     

     

    রিভার্স সুইপে ‘রিভার্স টার্ন’

    পূর্বসূরি মিসবাহ উল হক প্রায়ই খেলতেন এই শট। আজহার আলীকেও যেন পেয়ে বসলো তা! ১৬তম ওভারের তৃতীয় বলে সাকিব আল হাসানকে রিভার্স সুইপ করতে গেলেন আজহার। আগে থেকে ভাবভংগি টের পেলেন মুশফিক, সরে গেলেন, প্রথমে ধরলেন বল। তবে বেরিয়ে গেল, মুশির পেটে লেগে ফিরে এল, আবার গ্লাভসবন্দি করলেন পাকিস্তান অধিনায়ককে। গত ম্যাচের মতো এ ম্যাচেও পাকিস্তানের ভরসা হয়ে ছিলেন, আউট হয়ে যেন ‘রিভার্স টার্ন’ মারলেন আজহার। রিভার্স সুইপের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব সামলানোটাও আরও শিখতে পারেন আজহার। মিসবাহর কাছে!  

     

     

    নাসিমের প্রত্যাবর্তন

    পাকিস্তানের হয়ে আগের ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল দুজনের। অভিষেক ম্যাচে মোহাম্মদ রিজওয়ান করেছিলেন ফিফটি। আর সাদ নাসিম মেরেছিলেন ‘গোল্লা’। তামিম ইকবালের গুরুত্বপূর্ন ক্যাচও ছেড়েছিলেন আবার! ওয়ানডে ক্রিকেট নিশ্চয়ই বিভীষিকাময় ঠেকছিল নাসিমের কাছে! তবে পরের ম্যাচেই ফিরে এলেন দারুণভাবে। রিজওয়ান এ ম্যাচে ব্যার্থ (১৩ রান) হলেও নাসিম করলেন ৭৭ রান। হারিস সোহেলের সঙ্গে ৬ষ্ঠ উইকেটে গড়লেন ৭৭ রানের জুটি, আর ওয়াহাব রিয়াজকে নিয়ে ৮৫ রানের জুটি ৭ম উইকেটে। পাকিস্তান তো ‘সম্মানজনক’ এক স্কোর গড়লো এ দুই জুটিতেই!

     

     

    নো বলের রিভিউ আর এক হাতের গ্লাভস

    ৪০তম ওভারের চতুর্থ বল। রুবেলকে নো ডাকলেন আম্পায়ার নাইজেল লং। রিপ্লেতে দেখা গেলো, পা পড়েছিল দাগের মধ্যেই। মাশরাফিও কম যান না, রিভিউ চেয়ে বসলেন (বা চাইতে গেলেন)! রিপ্লে দেখে রিভিউ, নির্ধারিত সময়সীমাও পেরিয়ে গেছে। অদ্ভূত রিভিউ তাই দেখা হলোনা! তবে দেখা মিললো কিন্তু একহাতে গ্লাভস পরিহিত উইকেটকিপারের। তাসকিনের করা শেষ ওভারে পাঁচটি বলই ছিল স্লোয়ার। মুশফিক তাই এক হাতের গ্লাভস খুলে পেছনে রেখেছিলেন, এক হাতের ‘ইনার গ্লাভস’ দিয়েই কাজ চলেছিল। বল ধরে থ্রো করতে যাতে সুবিধা হয়। তবে রানআউটের দেখা মেলেনি!

     

     

    হাফিজের হাহাকার

    বর্তমান পাকিস্তান দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার তিনি। কালকের ম্যাচের আগে ১৫৬টি ওয়ানডে খেলা মোহাম্মদ হাফিজ এ সিরিজে খেলছেন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হিসেবে। বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষার ফল পাননি বলে করতে পারছেন না বল। তবে সিরিজের দুই ম্যাচে হাফিজের অবদান সাকল্যে চার রান! তাও করেছিলেন প্রথম ম্যাচেই! কাল ‘গোল্লা’ মেরেছেন। দুই ম্যাচে ক্যাচও ধরা হয়নি তাঁর! এক ম্যাচ বাকি থাকতেই সিরিজ হারতে বসা পাকিস্তানের প্রতিচ্ছবিই তো হাফিজের ফর্ম!

     

     

    হ্যাটট্রিক

    না উইকেটের হ্যাটট্রিক হয়নি কাল। তবে এক ওভারে চারের হ্যাটট্রিক হয়েছে। একটি দুটি নয়, পাঁচটি! সবকটিই বাংলাদেশ ইনিংসে। প্রথম শুরু করেছিলেন সৌম্য সরকার, ৩য় ওভারে জুনাইদ খানকে দিয়ে। এরপরের তিনটি তামিম ইকবালের। ৬ষ্ঠ ওভারে রাহাত আলী, ৯ম ওভারে সাঈদ আজমল ও ১০ম ওভারে ওয়াহাব রিয়াজকে টানা তিনটি করে চার মেরেছিলেন বাংলাদেশী ওপেনার। ২২তম ওভারে মুশফিকুর রহিমের হ্যাটট্রিকের শিকার আবার রাহাত আলী। পুরো ইনিংসেই সবচেয়ে বড় ঝড়টা বয়ে গেছে রাহাতের ওপর দিয়ে। ৭ ওভারে ৫৭ রান দিয়ে পাকিস্তানের সবচেয়ে খরুচে বোলার তিনিই।

    মুশফিকের উইকেটটা সান্ত্বনা হিসেবেও কম নয় কি রাহাতের কাছে!

     

     

    মুশ্লগার

    এ সময়ে সবচেয়ে ভাল স্লগ সুইপ করেন কে? প্রশ্নের জবাবে আগেভাগেই আসবে মুশফিকুর রহিমের নামটা। আগের ম্যাচেই অসাধারণ সেঞ্চুরিতে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন, কালও খেললেন অসাধারণ এক ইনিংস। অথচ শুরুর দিকে মুশফিক ছিলেন প্রায় ঝিম মেরে। প্রথম ১১ বলে কোনো রান নেই। এরপর খুললেন রানের খাতা। ১৫ বলে ৩ রানে দাঁড়িয়ে সাঈদ আজমলের করা ফুল লেংথের মিডল স্টাম্পের বলকে ডিপ মিডউইকেট দিয়ে উড়িয়ে মারলেন মুশি, স্লগ সুইপ করে। ছক্কা! নিজের প্রথম বাউন্ডারি, যখন ৬৮ বলে ৬৫ রান করে থামলেন, তখন তার নামের পাশে ওই ছয়ের সঙ্গে ছিল আরও ৮টি চার।

    ইনিংসের ২২তম ওভারে রাহাত আলীকে তিনটি চার মেরেছিলেন পরপর, তৃতীয়টিতে প্রায় বোল্ড হয়েছিলেন ইনসাইডেজ হয়ে। ২৪তম ওভারেও প্রায় এলবিডাব্লিউ হয়েছিলেন, জুনাইদ খানের বলটি লেগ স্টাম্পে ক্লিপ করায় বেঁচে যান আম্পায়ার্স কলের মাধ্যমে। স্লগ সুইপের মত ‘সাহসী’ শট যিনি খেলেন, ভাগ্য তাঁর দিকে একটু ফিরে তো তাকাবেই!

    ওই যে বলে না, ‘ফরচুন ফেভারস দা ব্রেভস’!   

     

     

    লর্ডস, ওল্ড ট্রাফোর্ড। মিরপুর, মিরপুর।

    বাংলাদেশের নতুন যুগের ক্রিকেটের অনেক বড় বিজ্ঞাপন তিনি। লর্ডস আর ওল্ড ট্রাফোর্ডে পরপর দুই সেঞ্চুরি বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের অনেক বড় এক বিজ্ঞাপন, সন্দেহ নেই তাতেও। তামিম ইকবাল এবার মিরপুরকে বেছে নিলেন, ঐতিহাসিক এক ওয়ানডে বিজ্ঞাপন তৈরী করতে। আগের ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে প্রায় দুই বছরের ওয়ানডে সেঞ্চুরি খরা কাটিয়েছিলেন, কাল আবার করলেন। সেই চিরচেনা তামিম ইকবাল ফিরে এলেন। ফুটওয়ার্ক সহ, ফুটওয়ার্ক ছাড়া খেললেন দৃষ্টিনন্দন সব শট। টানা তিন চারে যখন ফিফটিতে পৌঁছালেন, তখনই ১২টি চার! পরে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে মারা এক ছয়ের সঙ্গে মেরেছেন আরও পাঁচটি চার। দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির তালিকায় এখন সাকিব আল হাসানের পাশে তাঁরও নাম (৬টি)। সমান ২৮টি করে ফিফটি আছে দুজনেরই!

    আগেরদিনের সেঞ্চুরির উদযাপন করেছিলেন ভিন্ন মাত্রায়, কাল একটু দৌড় দিলেন, ব্যাটটা ঘোরালেন বারতিনেক। মুখে ছিল ভুবনভোলানো হাসি।

    তামিম ইকবাল খানের সেই হাসিতে তাঁর চরম নিন্দুকের মুখেও হাসি ফুটতে বাধ্য। তাঁর ব্যাটিংটাই যে এমন আগ্রাসী সৌন্দর্যে ভরা!  

     

     

     

    এবং আলোর ঝলকানি!

    ৩০তম ওভারের পঞ্চম বলের পর হঠাৎই ফ্লাড লাইটের আলো কমে আসতে শুরু করলো মিরপুরে। ড্রিংকস ব্রেক এগিয়ে আনা হলো, মিনিট পনেরো পর খেলা শুরু হলো আবার। তবে তাতে ছেদ পড়েনি বাংলাদেশের রান তাড়ায়। তামিম-মুশফিকের আবারও তিন নম্বরে সেঞ্চুরি জুটি। আবারও বাংলাদেশের জয়।

    পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়।

    আর বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন আলোর ঝলকানি!