• অ্যাশেজ
  • " />

     

    কুক-অর্কেস্ট্রার বিস্ময়-সুর

    কুক-অর্কেস্ট্রার বিস্ময়-সুর    

    ১.

    ‘ওহ ইয়েস! ইয়েস ইয়েস ইয়েস! দ্য আর্ন ওয়াজ রিগেইনড, রিডেমপশন ইজ কমপ্লিট।
    অস্ট্রেলিয়া, হ্যাভ বিটেন ইংল্যান্ড, বাই ফাইভ টু নাথিং’!

    চ্যানেল নাইনের ধারাভাষ্যে মার্ক নিকোলাস যেন ঘোষণা দিচ্ছিলেন, ইংল্যান্ডের একটা যুগের সমাপ্তি-সংগীতের। সময়টা ৫ জানুয়ারি, ২০১৪। সিডনি।

     

    যে যুগের ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়াকে তাদের মাটিতে ২৪ বছর পর হারিয়েছিল, টানা তিনটি অ্যাশেজ জিতেছিল। সে যুগের সমাপ্তির। জোনাথন ট্রট, গ্রায়েম সোয়ানরা সিরিজের মাঝপথেই চলে এসেছিলেন। অবসন্নতায় ভুগে, অবসর নিয়ে। কেভিন পিটারসেনকেও ওই সিরিজের পরই হারিয়ে ফেলল ইংল্যান্ড। রয়ে গেলেন একজন। অনেক ঝড়-ঝাপটার আশংকা নিয়ে।

     

    ‘সংগীতই আমাকে শিখিয়েছিল, লক্ষ্য স্থির রাখতে। অর্কেস্ট্রাতে বাজানোর আগের মুহুর্তটাই শিখিয়েছিল, কীভাবে সত্যিকারের মনোযোগ দিতে হয়। যদি অর্কেস্ট্রাতে আপনি আপনার সঠিক ক্ষণটা হারিয়ে ফেলেন, কোনোই ক্ষমা নেই!’, সংগীতের এককালের গুনমুগ্ধ ছাত্র একবার বলেছিলেন। সেই ছাত্রই দলপতি, তাঁর  হাতেই যেন রইল একটা অর্কেস্ট্রা দল। সুর হারিয়ে ফেলা, খেই হারিয়ে ফেলা, অনেক অনভিজ্ঞদের নিয়ে গড়া একটা অর্কেস্ট্রা দল। অ্যালেস্টার কুকের ঝুঁকি ছিল, সঠিক ক্ষণটা হারিয়ে ফেলার। সবসময়!

    তারপর?

     

    ২.

    শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অসাধারণ এক সিরিজ। দুটি টেস্টই গড়ালো শেষ ওভারে, শেষ দিনে। লর্ডসে এক উইকেট নিয়ে ড্র করলো শ্রীলঙ্কা। হেডিংলিতে এক বল বাকী থাকতে আউট হলেন জিমি অ্যান্ডারসন! অ্যাশেজ হারের পর টেস্টের অসাধারণ রোমাঞ্চ নেয়ার ‘বিলাসিতা’র সুযোগ নেই তখন ইংল্যান্ডের! সিরিজ যে হারতে হলো! তারপর?

    ১১২৮ দিন পর ভারত বিদেশের মাটিতে টেস্ট জিতলো। ২৮ বছর পর, জিতলো ক্রিকেটের মক্কা, লর্ডসে। ইংল্যান্ডের সঙ্গেই, অবশ্যই! কুক এবার হারিয়ে ফেললেন তাঁর ‘অর্কেস্ট্রা’ দলের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে। ম্যাথু প্রায়র। সিরিজে ফিরে এলো ইংল্যান্ড, শেষ তিন টেস্ট জয়ে সিরিজও জিতলো ৩-১ তে। একটু সুর যেন ফিরলো। ফিরলো না শুধু দলপতির উইলো কাঠের ওই বেহালায়। অ্যালেস্টার কুক এবার প্রশ্নের সম্মুখীন তাঁর ব্যাটিং ফর্ম নিয়ে। ৩১ ইনিংস ধরে টেস্টে যে মেলেনি তিন অংকের দেখা!

    বিশ্বকাপের আগ দিয়ে শ্রীলঙ্কায় রঙ্গীন পোশাকে খেলতে গেল ইংল্যান্ড। ৭ ম্যাচের সিরিজটা হারলো ৫-২তে।  এক ম্যাচ বরখাস্ত ছিলেন স্লো ওভার-রেটের কারণে, বাকী ছয় ম্যাচে করলেন ১৯.৮৩ গড়ে ১১৯ রান। কুক বাদ পড়লেন দল থেকে! হ্যাঁ, বিশ্বকাপের দুই মাস আগে, বিশ্বকাপের আগে শেষ সিরিজের পর ইংল্যান্ড তাঁদের অধিনায়ককে ‘বরখাস্ত’ করলো। অ্যালেস্টার কুকের নয়, এউইন মরগানের ওয়ানডে দল বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়লো, বাংলাদেশের সঙ্গে ‘বাঁচা-মরার’ ম্যাচে হেরে।

     

    ৩.

    আবার সেই কুক, সেই অর্কেস্ট্রা। রঙ্গীন পোশাকের বিবর্ণ ইংল্যান্ডের সাদা পোশাকে যাত্রা এবার ক্যারিবীয় অভিমুখে। প্রথম দুই টেস্টের একটিতে জয়, আরেকটি ড্র। ব্রিজটাউনে কুকের গ্রে নিকোলসে ‘তিন অঙ্কের সুর’ উঠলো। প্রায় দুই বছর আর ৫১ আন্তর্জাতিক ইনিংস পর কুক পেলেন সেই তিন অংকের দেখা। তবে সুর কেটে গেল তাঁর দলের, ক্যালিপসো ছন্দে হারিয়ে গেল ইংলিশ-অর্কেস্ট্রা! সিরিজ ড্র করেই তাই ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফিটা নিজেদের কাছে রাখতে হলো!

    এরপর নিউজিল্যান্ড। লর্ডসে কুকের ব্যাট হাসলো, হাসলো ইংল্যান্ডও। পরের ম্যাচেই ছন্দপতন। হেডিংলিতে হেরে এই সিরিজও ড্র। তবে ‘নতুন ব্র্যান্ডের’ ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছে তখন ইংল্যান্ড, আক্রমণাত্মক ক্রিকেট। কুকের অধিনায়কত্বেও এসেছে পরিবর্তন।

    তবে এসবই কি যথেষ্ট, এই গ্রীষ্মে অ্যাশেজের জন্য!

    অ্যাশেজ। ৫-০তে হেরে খুইয়ে আসা সেই ‘আর্ন’ পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে নামবে এবার ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডকে নিয়ে আশাবাদ? নাহ্‌, নেই খুব একটা!

     

    ৪.

    এতক্ষণ কথা হলো শুধু মাঠের ক্রিকেট নিয়েই। এ সময়ে মাঠের বাইরে কেমন ছিল ইংল্যান্ডের ক্রিকেট? চলেছে নাটক। অবিরত। কেভিন পিটারসেন, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, পিটার মুরস, জাইলস ক্লার্ক, পল ডাউনটাউন, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসরা যেখানে ‘রোল প্লে’ করে গেছেন, অবিরাম। কোচ এসেছেন, কোচ গেছেন। পিটারসেন প্রায় ফিরে এসেছিলেন। আর অ্যালেস্টার কুকও অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেয়ার কথা ভেবেছিলেন। অনেকদিনের সতীর্থ, জিমি অ্যান্ডারসনেরও একসময় মনে হয়েছিল, দায়িত্বটা বোধহয় ছেড়েই দেবেন ‘কুকি’!

     

     কুক যখন বাবা

     

    তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে যে এ সময় জুড়েই প্রশ্ন উঠেছে অবিরাম! প্রশ্ন উঠেছে তাঁর ব্যক্তিত্ব নিয়েও! সমালোচকরা মুখর হয়েছেন বারংবার। তবে দলকে এমন অবস্থায় ছেড়ে যেতে চাননি। নিজের ব্যাটিংয়ের ওপর সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ছে জেনেও অধিনায়কত্ব ছাড়েননি তিনি! সবার আগে যে দলের কথা ভেবেছেন, তরুণ একটা দলের চাপটা নিজের কাঁধে নিতে চেয়েছেন! বলে গেছেন, অধিনায়কত্ব, দলের দায়িত্বের চ্যালেঞ্জ নিতে তিনি ভালবাসেন। যে চ্যালেঞ্জে পা হড়কেছেন বারবার, সেই চ্যালেঞ্জেরই মুখোমুখি হওয়ার স্পৃহাটা টিকিয়ে রেখেছিলেন তিনি।

    অ্যাশেজকেই হয়তো নিয়েছিলেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে!

     

    ৫.

    বোল্ড-ইম, ড্র্যাগড অন। উড দ্য ম্যান, উইথ দ্য ফাইনাল উইকেট! ফাইভ হান্ড্রেড অ্যান্ড নাইনটি নাইন ডেজ, আফটার হ্যান্ডিং ওভার দি আর্ন টু অস্ট্রেলিয়া, কুক হ্যাজ হিজ রিডেমপশন!’

    এবার স্কাইয়ের ধারাভাষ্য, নাসের হুসেইনের কন্ঠে যেন এবার নতুন ইংল্যান্ডের আগমনী বার্তার ঘোষণা! যেন নতুন সুরের ঘোষণা!

    নতুন কোচ ট্রেভর বেইলিস,  দলটাও নতুন। অধিনায়কেরও যেন নতুন ‘জন্ম’। শেষ অ্যাশেজের আঘাত ভুলে এক ম্যাচ বাকী থাকতেই অ্যাশেজ জয়! সুর হারিয়ে ফেলা, খেই হারিয়ে ফেলা, অনভিজ্ঞদের নিয়ে গড়া সেই অর্কেস্ট্রা দলই যেন বাজিয়ে চলেছে নতুন সুর। দলপতি হিসেবে কৃতিত্ব প্রাপ্য যাঁর, সেই তিনিই বিলিয়ে দিচ্ছেন তা দলের মাঝে। কোচিং-স্টাফদের মাঝে। এমনকি সাবেক কোচ পিটার মুরসকেও ‘ধন্যবাদ’ জানাতে ভুল হয়না তাঁর!

     

     

    ম্যাচের স্মারক স্ট্যাম্প নিজে সংগ্রহ করে দিয়ে দেন, জো রুট, বেন স্টোকস বা মার্ক উডের হাতে! আবেগ প্রকাশ করেন না সহজে, তবে পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে গিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরে তাঁর! ভেংগে পড়েন, সামলিয়ে নেন পরক্ষণেই! মাত্রই তৃতীয় ইংলিশ অধিনায়ক হিসেবে ঘরের মাটিতে টানা দ্বিতীয় অ্যাশেজ জয়ের রেকর্ডের মালিক এখন অ্যালেস্টার কুক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে সেই অধিনায়ক হিসেবে, কোনো এক ইংলিশ গ্রীষ্মে যিনি বিস্মিত করেছিলেন প্রায় সবাইকেই।

     

    মনে রাখবে সেই দলপতি হিসেবে, যাঁর অর্কেস্ট্রা তুলেছিল এক অদ্ভুত সুর। কার্ডিফে, এজবাস্টনে, ট্রেন্টব্রিজে। ওভালের অধ্যায়টা যেমনই হোক, ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদার ওই স্মারকটা উঠবে তো ওই দলপতির হাতেই!

     

    কুক-অর্কেস্ট্রার কারণেই হয়তো এই গ্রীষ্মটা আলাদা করে মনে রাখবে ইংল্যান্ড।
    মনে রাখবে অ্যাশেজও।